বৃহস্পতিবার , ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইটি বিশ্ব
  3. আজকের পত্রিকা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. ইসলাম ও জীবন
  6. একদিন প্রতিদিন
  7. কোভিড-১৯
  8. খেলা
  9. চাকরি
  10. চিত্র বিচিত্র
  11. জনপ্রিয় সংবাদ
  12. জাতীয়
  13. ডাক্তার আছেন
  14. দরকারি
  15. দৃষ্টিপাত

প্রবাসীদের অশ্রুজল: হৃদয়বিদারক কিছু সত্য গল্প

প্রতিবেদক
newsupload
ডিসেম্বর ৫, ২০২৪ ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ার শাহজাহান, দুবাই হতে :
¤ স্বপ্ন আর বাস্তবতার চরম বৈপরীত্য
বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল শহর দুবাই, যা পরিচিত স্বপ্নপূরণের জায়গা হিসেবে। রাতদিন সমান ব্যস্ত এই শহরে আকাশচুম্বী দালান, বিলাসবহুল জীবনযাপন, এবং অগ্রগতির ছটা প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে মানুষকে। তবে এই স্বপ্নময় শহরের আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজারো প্রবাসীর ত্যাগ, কষ্ট, আর অশ্রুর গল্প। দেশের মায়া আর পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে প্রবাসীরা পাড়ি দেন এখানে। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতায় সেই স্বপ্ন পরিণত হয় তিক্ত অভিজ্ঞতায়।
মাহমুদুল হাসান, বয়স ৩২। একসময় বাংলাদেশের একটি গ্রামের স্কুলশিক্ষক ছিলেন। পরিবারের দারিদ্র্য, মায়ের চিকিৎসার খরচ, আর ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজের পেশা ছেড়ে ২০১৮ সালে দুবাই আসেন। স্থানীয় এক এজেন্টের মাধ্যমে জমানো সব টাকা খরচ করে নতুন জীবনের আশায় পাড়ি দেন এই শহরে।
প্রথমে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করে মাসে ১,১০০ দিরহাম আয় করতেন। এত দীর্ঘ পরিশ্রম করেও বাড়িতে টাকা পাঠানো দূরে থাক, নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতেন।
২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে গেলে চাকরি হারান। এরপর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনি ভিসাবিহীন অবস্থায় দিনমজুরির কাজ করতে বাধ্য হন।
তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল মায়ের মৃত্যু। টাকা জমাতে না পারায় মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে ব্যর্থ হন। ফোনে মায়ের কান্না শুনেও কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে আজও তাড়া করে। মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
বর্তমানে তিনি একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিচে ছোট্ট একটি কক্ষে থাকেন। কোনো দিন কাজ পান, কোনো দিন পান না। প্রতিদিন তার জীবন যেন একেকটি যুদ্ধ।
আব্দুল হাকিম প্রথমবারের মতো দুবাই আসেন ১৭ বছর আগে। তখন নিয়মিত কাজ করতেন, দেশে টাকা পাঠাতেন। তবে ৭ বছর আগে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
ভিসাহীন অবস্থায় দিনমজুরির কাজ শুরু করেন, যা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি পাঁচজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে একটি ছোট্ট কক্ষে থাকেন। দিনের বেশিরভাগ সময় কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ান। সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা, তিনি তার মেয়েকে কখনো চোখে দেখেননি। দুবাই আসার পর মেয়ের জন্ম হয়। এখন বয়েস ১৭ এর কাছাকাছি। তার মেয়ে এখন বিয়ের উপযুক্ত। কিন্তু তিনি বিয়ের খরচ জোগাড় করতে পারেননি। লজ্জা আর কষ্টে দেশে ফিরতেও পারছেন না।
২০২১ সালে সেলিম আহমদ ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দুবাই আসেন। সেই স্বপ্ন পূরণে ২০ হাজার দিরহাম তুলে দেন এক দালালের হাতে। কিন্তু সেই দালাল প্রতারণা করে পালিয়ে যায়।
ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা নবায়নের টাকা জোগাড় করতে না পেরে তিনি পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ২০২৩ সালে তার বাবার মৃত্যুর খবর পেলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বাবার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে না পারার কষ্ট তাকে আজও তাড়া করে।
জামাল উদ্দিন ২০১৬ সালে গ্রামের সমিতি থেকে সুদে টাকা নিয়ে দুবাই আসেন। তার আশা ছিল দুই বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করবেন। শুরুতে একটি নির্মাণকাজের কোম্পানিতে কাজ পান। কিন্তু ২০২০ সালে কাজের সময় একটি দুর্ঘটনায় তার ডান হাত মারাত্মকভাবে জখম হয়। তিনি কাজ হারান। কোম্পানি তার চিকিৎসার খরচ বহন করলেও দেশে ফেরার টিকিট দেয়নি।
বর্তমানে তিনি দুবাইয়ের মানবেতর পরিবেশে জীবন কাটাচ্ছেন। দেশে ফেরার কোনো উপায় নেই। তার পরিবার সমিতির সুদের চাপে দিশেহারা। তার ছোট ছেলে ফোনে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “বাবা, তুমি ফিরবে কবে?” তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
দুবাইতে বিলাসবহুল হোটেলে লাখ টাকার খাবার খাওয়ার মানুষের দেখা মেলে। কেউ মাসে লাখ দিরহাম আয় করেন, বিলাসী জীবনযাপন করেন। অথচ একই শহরে হাজার হাজার শ্রমিক ন্যূনতম বেতনেও কঠিন জীবনযাপন করেন।
এই শহরের চোখধাঁধানো অগ্রগতির পেছনে রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম, কষ্ট, আর ত্যাগ। তাদের কষ্ট আর পরিশ্রমেই গড়ে উঠেছে আধুনিক দুবাই।
ভিসাহীন প্রবাসীদের বৈধতার সুযোগ দেওয়া এবং দেশে ফেরার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। সরকার যদি তাদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করত, তবে তারা দেশে ফিরে নতুন জীবন শুরু করতে পারত।
প্রবাসীরা দেশের জন্য নিজেদের সুখ বিসর্জন দেন। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো আমাদের দায়িত্ব। তাদের গল্প আমাদের শেখায় সহানুভূতির মূল্য।
আজ বাংলাদেশ সরকারের সময় এসেছে এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। তাদের কষ্ট ভাগ করে নেওয়া, তাদের দুঃখ বুঝতে শেখা, এবং তাদের নতুন স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করা—এটাই আমাদের মানবিক দায়িত্ব।
মাহমুদুল হাসান, আব্দুল হাকিম, সেলিম আহমদ, কিংবা জামাল উদ্দিনের মতো হাজারো প্রবাসী কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছেন। তাদের দুঃখ-কষ্টকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাদের প্রতি আমাদের সরকারের সহানুভূতি, সহযোগিতা, আর ভালোবাসা তাদের জীবন পাল্টাতে পারে।
আমাদের নতুন সরকারের প্রতিজ্ঞা হোক—এই স্বপ্নবাজ প্রবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের স্বপ্ন পূরণের অংশীদার হওয়া।
প্রবাস জীবনের এমন হৃদয়বিদারক গল্পগুলো আমাদের চোখে আনে জল, আর মনে করিয়ে দেয় প্রবাসীদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কথা। তারা দেশ ও পরিবারের জন্য যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেন, তা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দাবিদার।
প্রবাসীদের এই কষ্ট ও লড়াইয়ের পেছনে রয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা এবং অসাধু দালালদের প্রতারণা। প্রতিদিন হাজারো প্রবাসী কঠিন পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছেন। তাদের সমস্যাগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া আমাদের মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব।
এই গল্পগুলো শুধু প্রবাসীদের কষ্ট নয়, আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ববোধও তুলে ধরে। তারা শুধু রেমিট্যান্স প্রেরণকারী নন; তারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া এবং তাদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এক: ভিসা বৈধকরণ প্রক্রিয়া সহজ করা: ভিসাহীন প্রবাসীদের বৈধকরণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন।
দুই : সাহায্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরি: যেসব প্রবাসী দেশে ফিরতে চান, তাদের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠন।
তিন: সামাজিক পুনর্বাসন: দেশে ফিরে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া।
চার: ঋণসুবিধা প্রদান: যারা ঋণের চাপে আছেন, তাদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ ব্যবস্থা।
আসুন, প্রবাসীদের এই ত্যাগ ও সংগ্রামকে সম্মান জানাই। তাদের কষ্ট লাঘবে নিজেদের মানবিক দায়িত্ব পালন করি এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করি।
।।
আনোয়ার শাহজাহান : সম্পাদক, মাসিক লন্ডন বিচিত্রা

সর্বশেষ - জনপ্রিয় সংবাদ